এ বছর আগস্টের শুরুর দিকে সাজেক উপত্যকা গিয়েছিলাম। খাগড়াছড়ির সাজেক পৌঁছে সেখানকার ঘরবাড়ি, হেলিপ্যাড, মানুষজন, নৃগোষ্ঠীর জীবনযাপন, আর নিসর্গের প্রবল রূপ দেখে মুগ্ধ আমরা। সাজেক থেকে ফেরার পথে আরও কত যে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল কল্পনাও করিনি। সাজেককে বিদায় জানিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের পথে রওনা হতেই মুঠোফোনে সুমনের ডাক, ‘ভাই হাজাছড়া ঝরনা দেখে আসবেন অবশ্যই।’ ঝরনার কথা শুনে সঙ্গীদের পাশাপাশি আমিও কেমন যেন একটা পুলক অনুভব করলাম। সামনে তাকাতেই দেখি চোখজুড়ানো সবুজ জুম। অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে আটকানো ছোট ছোট ঘরবাড়ি। সে দৃশ্যই যেন টেনে নিয়ে গেল হাজাছড়ার দিকে।................................
শরৎকাল চলে এলেও টানা বৃষ্টিতে বর্ষার কথাই মনে হচ্ছিল প্রতিদিন। সেদিনের সকালটাও শুরু হয়েছিল অঝোর বৃষ্টিতে। রোদ-বৃষ্টির যুগলবন্দীর দুপুরে আমাদের মাইক্রোবাস ছুটে চলল বাঘাইহাটের হাজাছড়ার দিকে। পাহাড়ঘেরা সবুজ বনপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। পথ চলছি সঙ্গে ক্যামেরা ক্লিক চলছে আর অল্প কিছু ভিডিও ফুটেজও নিচ্ছি। এরই মাঝে বাইরে দৃষ্টি পড়তে দেখি বিচ্ছিন্ন বসতির অনেক পাহাড়ি শিশুরা আমাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথ চলতে চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম বাঘাইহাটের কাছে হাজাছড়া। পথের পাশেই ছোট্ট করে লেখা শুকনাছড়া ঝরনা। এলাকার নাম হাজাছড়া তাই ঝরনার নামও লোকমুখে হাজাছড়া হয়ে গেছে। আমরা মাইক্রোবাস থেকে যেখানে নামলাম তার পাশেই একটি মনিহারি দোকান। দোকানির বউ বসে দাবা টানছেন। পাশে দোকানি দা দিয়ে মুলি বাঁশ কাটছেন। এখানে বলে রাখি দাবা হচ্ছে হুকোর পাহাড়ি রূপ। লম্বা বাঁশের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে বাঁশে মুখ লাগিয়ে দম দিলেই ধোঁয়া বের হচ্ছে।
হাজাছড়া ঝরনাটি মোটামুটি খুব পরিচিত আর জনপ্রিয়। পথের ধারে এমন একটি চমৎকার ঝরনা জনপ্রিয় না হয়ে পারে না। কারণ অবশ্য আছে। মনিহারি দোকানির স্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ঝরনা কত দূর। তিনি বললেন, ১৫ মিনিট হাঁটো, ঝরনা পেয়ে যাবে। এবার সবুজ জংলার পথ। পথের সৌন্দর্য এককথায় অসাধারণ। দুপাশেই বন কেওড়ার মেলার সঙ্গে নাম না জানা গাছ মিলে এক অনবদ্য শোভার দেখা পেলাম। পরিচিত নিশিন্দা রয়েছে দেখলাম। এই সময়টা ফুলে ফুলে মাতোয়ারা হওয়ার সময় নয়, তবে বৃষ্টির ছোঁয়ায় চারদিক কী অসাধারণ সবুজ, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এমন সবুজকে সঙ্গী করে আমরা ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে চলি, আঁকাবাঁকা পথে। সে পথেই দেখা হয় দুই স্কুল-ফেরত বালিকার। তাদের ছবি ক্লিক হয় যখন, তখন বালিকারা ঝিরির কোমরপানি পার হচ্ছিল। আমরা ছায়াঘেরা সে ঝিরিপথ পেরিয়েই শুনি ঝরনার জলের শব্দ। সঙ্গে গায়ে ছুটে আসে পানির ঝাঁপটা। এর মধ্যে শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আমরা মাটির সোঁদা গন্ধ নিয়ে আরও সামনে এগিয়ে যাই, তারপরই চোখ ছানাবড়া। অনেক বিস্ময় নিয়ে সামনে তাকাই। কী অপরূপ উচ্ছ্বাস। ফারাবী ‘ওই তো ঝরনা’ বলেই ছুট লাগায়, সঙ্গে প্লাবন আর শরীফ। সম্রাট একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ঝরনার দিকে। একসময় অস্ফুটে বলে ওঠে ‘আহ্ হাজাছড়া!’
জেনে নিন
হাজাছড়া ঝরনা খাগড়াছড়ির বাঘাইহাটের হাজাছড়ায় অবস্থিত। অবশ্য হাজাছড়া পৌঁছালে সাইনবোর্ডে লেখা পাবেন শুকনাছড়া। শুকনাছড়াই হাজাছড়া। এ ঝরনা দেখতে হলে আপনাকে খাগড়াছড়ি যেতে হবে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। খাগড়াছড়ি নেমে মোটরসাইকেল, চান্দের গাড়িতে কিংবা দলবেঁধে গেলে নিজস্ব পরিবহনে চলে আসুন বাঘাইহাটের হাজাছড়া। হাজাছড়া গেলে সাজেক ঘুরে আসতে ভুল করবেন না। সবচেয়ে ভালো সাজেক হয়ে তারপর চলে আসুন হাজাছড়া ঝরনার কাছে।
No comments:
Post a Comment