Saturday, July 30, 2016

বর্ষায় বাংলার রূপ



পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বুঝি বদলে যাওয়া আকাশের রং। যে আকাশ আলতারাঙা ভোর নিয়ে দিন শুরু করে, সে আকাশই আবার ঝকঝকে নীল হয়ে জাপটে ধরে নীল-সবুজের গোল পৃথিবীটা, আর দিন শেষে সোনালি রং ছড়িয়ে সৌরজগৎকে জানিয়ে দেয় এই পৃথিবীটা অমূল্য। আকাশের এই রঙের বদলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে মেঘ। মেঘ বরাবরই খুব প্রিয়, আর................................
সেটা যদি হয় বর্ষাকালের নাটাই ছেঁড়া মেঘের ভেলা, তাহলে তো কথাই নেই। মাঝে মাঝেই এক দিনের ভ্রমণে বের হই। এর উদ্দেশ্যই থাকে এক দিনের মধ্যে সুন্দর একটি জায়গা দেখে আবার ঘরে ফিরে আসা। এবারের যাত্রাপথ বেশ লম্বা। ভোর ছয়টায় ঢাকা থেকে বের হয়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ফেরিঘাট-শরীয়তপুর-মাদারীপুর-ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট-পিরোজপুর-ঝালকাঠি-বরিশাল-ভোলা হয়ে নোয়াখালী-কুমিল্লা দিয়ে ঘরে ফেরা! এই এক দিনে বাংলার বর্ষাকালের অসাধারণ রূপ দেখে ফেলেছি, এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিল বরিশাল থেকে ভোলার লঞ্চ ভ্রমণ। মাত্র ৪৫ মিনিটের এক নদীপথ এ দেশের সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার পুরো মানসচিত্রই পাল্টে দিয়েছে। ভোর ছয়টায় আমি আর জাফর বাসা থেকে বের হয়েছি। গন্তব্য দূর-অস্ত! বেলা তিনটায় যখন বরিশালের লঞ্চঘাটে পৌঁছাই, তখন ভোলার শেষ লঞ্চটা মাত্রই ছেড়ে গেল ঘাট থেকে, লঞ্চের পেছন দিকটা দেখে হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের। এমন সময় পাশের একজন বললেন, আপনারা এক কাজ করেন, নৌকা দিয়ে এই নদীটা পার হয়ে ওপার থেকে মোটরসাইকেল বা বাস দিয়ে ‘লাহারহাট’ ঘাটে চলে যান। এই লঞ্চই দেড় ঘণ্টা পর লাহারহাট পৌঁছাবে, ধরতে পারবেন। অথই সাগরে পড়লে মানুষ নাকি বাঁচার জন্য খড়কুটো হলেও আঁকড়ে ধরে, আমরা ধরলাম নৌকা। নদী পার হয়েই একটা মোটরসাইকেল নিয়ে হুঁশ করে ছুটে চললাম লাহারহাটের দিকে। ঘাটে পৌঁছে দেখি আরেকটা ছোট লঞ্চ বরিশাল যাওয়ার জন্য ছাড়ছে, তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম শেষ লঞ্চে।
সব সময় পড়ে এসেছি দেশের এই দক্ষিণাঞ্চলে শত শত দ্বীপ রয়েছে, কিন্তু কখনোই নিজ চোখে সেগুলো দেখা হয়নি। লাহারহাট লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়া মাত্রই মুগ্ধতার শুরু হলো। ছোট্ট লঞ্চের ছাদে উঠে যেদিকে তাকাচ্ছি মুখ হাঁ হয়ে আছে, বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই! এখানে আকাশ অনেক বড়। মেঘগুলো খুব কাছ দিয়ে হেলেদুলে উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। ছোট ছোট অনেক নদী কোথায় থেকে যেন একসঙ্গে এসে এখানে মেঘনায় মিলেছে, মনে হচ্ছে যেন সবাই দাওয়াতে এসেছে। এখানের পুরো আকাশ যেন শিল্পীর চিত্রপট। এই সাদা মেঘের ভেলা, তো একটু পরই কমলা, কালো-বাদামি মেঘের দৌড়াদৌড়ি আর নিচের দ্বীপগুলো বর্ণনাতীত সুন্দর। মাঝে মাঝে একটা করে ঘর কে বা কারা যেন উঠিয়ে রেখেছে দ্বীপের একেবারে শেষ মাথায়, নদীর কাছাকাছি, মন চায় লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে ওখানে গিয়ে কাশবনের জঙ্গলে শুয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পার হয়ে যায় গরু’র মতো বিলের ওপর দিয়ে কয়েক শ গরু হেঁটে চলে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে তারা জানে না, সামনে যত দূর চোখ যায় অবারিত জলরাশি! তাদের আবার রাখালও আছে, স্কুলফেরত এক রাখাল বালিকা গরুগুলোর পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছে নদীর ওপর দিয়ে।

এখানে এসে অনেক দিন পর পালতোলা নৌকা দেখতে পেলাম। নাগরিকজীবনে সবার মধ্যে তাড়াহুড়ো থাকে, সবাই ব্যস্ত, কিন্তু এখানে কোনো ব্যস্ততা নেই, নানান রঙের পাল তুলে দিয়ে নৌকাগুলো বাতাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে—স্রোত যেদিকে নিচ্ছে, সেদিকে যাচ্ছে। এই সাদা রঙের পাল তো, একটু দূরেই টকটকে লাল পাল, আবার একসঙ্গে অনেক রঙের কাপড় ভাসছে নদীর বুকে। ঝিরঝিরে বাতাসে যেন রঙের মিছিল লেগেছে। এর মাঝেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব দিক রাঙিয়ে জন্ম নিল এক টুকরো রঙের মিছিল, মিনিটে মিনিটে সে মিছিলে যোগ দিল আরও রং—বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল...
৪৫ মিনিটের ছোট্ট এই যাত্রা এই দেশকে যেন অন্যভাবে চিনিয়েছে। নদী, নদীর পাশের কাশফুল, পালতোলা নৌকা, মেঘ, রংধনু, খালভর্তি হাঁস, নদী ভরা গরু—এদের ভুলে যাওয়া অসম্ভব। সবচেয়ে বাজে ক্যামেরা দিয়েও যদি এখানে কেউ ছবি তোলে, সেটাই হবে সবচেয়ে সুন্দর একটা ছবি। মন খারাপের চূড়ান্ত নিয়ে যদি আপনি এই যাত্রা শুরু করেন, ঝুড়ি ভর্তি রুপালি ইলিশে দেখে মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গে সেই মন খারাপ হারিয়ে যাবে সুদূরে। শেষ বিকেলের আলোতে পুরো মেঘনার পানি রুপালি বর্ণের হয়ে যায়।
প্রয়োজনীয় তথ্য







ঢাকা-বরিশাল লঞ্চে গেলে এই সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাবেন না। এর জন্য আপনাকে বরিশাল লঞ্চঘাট পর্যন্ত যেতে হবে, সেখান থেকে ভেদুরিয়া ঘাট। পুরো মেঘনা নদী তার সবটুকু রূপ নিয়ে এখানে বসে আছে, সেটা দেখতে হলে এই নদী দিয়েই যেতে হবে ভেদুরিয়া ঘাটে। লাহারহাট থেকে লঞ্চভাড়া নেবে ৩৪ টাকা। দুপুরের লঞ্চে রওনা দিয়ে বিকেলের লঞ্চে আবার বরিশাল ফেরত আসতে পারবেন। আরেকটু ঘুরতে চাইলে ভেদুরিয়া ঘাট থেকে ভোলার ‘ইলশা ঘাটে’ যাবেন। সেখান থেকে বিকেল চারটার শেষ ট্রলারে করে উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে নোয়াখালী, সময় লাগবে দুই ঘণ্টার বেশি। নোয়াখালী থেকে বাসে করে বাসায় চলে আসতে পারবেন।

No comments:

Post a Comment