Thursday, July 21, 2016

সুর্য যেখানে ডুব দেয়











অ্যাডভেঞ্চার যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধেও ঘরে রাখা সম্ভব না। এই যাত্রার শুরুটাই হয়েছে লঞ্চ ধরার অ্যাডভেঞ্চার দিয়ে। যে লঞ্চ ছাড়ার কথা ঠিক বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে, সেই লঞ্চ আমরা টেনেটুনে ঘাটের সঙ্গে আটকে রেখেছি ৫টা ৫৭ মিনিট পর্যন্ত—আমাদের দুজন সময়মতো এসে পৌঁছায়নি বলে। হাদী ভাই আর তামান্না ভাবি সদরঘাটের তীব্র যানজটে সিএনজি ছেড়ে পাক্কা সাড়ে তিন কিলোমিটার দৌড়ে এসে যেই না লঞ্চে উঠলেন, তখনই সশব্দে হুড়হাড় করে ছেড়ে দিল আমাদের ভ্রাম্যমাণ এক রাতের বাড়ি। সেই মুহূর্ত থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের শুরু।

এরপর লঞ্চ ছাপিয়ে অ্যাডভেঞ্চার ছড়িয়ে গেছে দোদুল্যমান ট্রলারে, এক আনাড়ি মাঝির হাতে পড়ে। হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাট থেকে রওনা দিলাম নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে। মাঝি সবাইকে ডান দিকে তাকাতে বলে চালায় বাঁ দিকে, আর বাঁ দিকে তাকাতে বলে সোজা ঠেকিয়ে দেয় কোনো এক বালুচরে! এভাবেই পৌঁছে যাই নোয়াখালী জেলায় বঙ্গোপসাগরের সর্বদক্ষিণের দ্বীপ নিঝুম দ্বীপে। কাদা, জল আর লোনা পানি ডিঙিয়ে যখন তীরে নামি, তখন পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছে রুপালি চাঁদের আভা।
এরপরের গল্পটুকু তুমুল উচ্ছ্বাসের, বাঁধভাঙা আনন্দের আর অজানাকে আপন করে নেওয়ার, মধ্যরাতে মাঝপুকুরে কাদাজলে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে গোসল করার, সারা নিঝুম দ্বীপ ঘুরে আটটা মুরগি এনে বারবিকিউ করার, বাঁশের আর গাছের সাঁকো পার হয়ে শুলোবনের মাঝ দিয়ে হরিণ খুঁজে বেড়ানোর, আর মধ্যরাতে চলল নিঝুম দ্বীপের সাদা বালুর সৈকতে জ্যোৎস্নায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস।
পরের দিনের শুরুটা হলো কবিরার চরের সবটুকু প্লাস্টিক আর অপচনশীল জিনিস খুঁজে বের করে আগুন জ্বালিয়ে। তাঁবু খাটিয়ে ইলিশ ও চেউয়া মাছ ভাজি দিয়ে বনভোজন শেষে যখন ঠিক হলো আমাদের সেদিনের রাত কাটবে নিঝুম দ্বীপের গহিন জঙ্গলে, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এ রাত হবে জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর রাত! তবে কে জানত সেই রাতে আমি, জাফর, কবির, মণ্ডল আর মাহফুজ জঙ্গলে ঢুকে যাব লাকড়ি টোকাতে! কে জানত, লাকড়ি খুঁজতে গিয়ে নিজের মাত্রই কিনে আনা মোবাইল ফোনটি জঙ্গলে হারিয়ে আসবে জাফর!
আমাদের ১১ জনকে নামিয়ে দিয়ে যে দলটা চলে গিয়েছিল বাকি সব বাক্সপেটরা নিয়ে আসতে, তারা পেয়েছে আরেক দারুণ দৃশ্য! ১৬ জনের দলটা রাত ১০টায় যখন বঙ্গোপসাগরে আবার নৌকা ভাসাল, ততক্ষণে তাদের পথ দেখাতে পুরো আকাশ আলো করে উঠল ফাল্গুনী পূর্ণিমার চাঁদ! উথালপাতাল বাতাস আর ঘোরলাগা চন্দ্রাহত হয়ে যখন তারা ভিড়ল মূল ক্যাম্পিং সাইটে, তখন সেটা একটা অন্য দুনিয়া—আগুন জ্বলছে তাঁবুগুলোকে ঘিরে। আর সেই আলোতে কেওড়াবনজুড়ে তৈরি হয়েছে মায়াবী এক লালচে মোহনীয়তা।
সেই রাতটা ছিল অস্থির এক মাদকতায় পূর্ণ! শহুরে যে ছেলেগুলো কোনো দিন নিজের বিছানা ছেড়ে মাটিতে ঘুমায়নি, তারাই ঘুমাল চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া খোলা জঙ্গলের এক তাঁবুতে। ঠান্ডায় শিশিরভেজা তাঁবুর পর্দায় কাঁপতে কাঁপতে বের হয়ে সেই আগুন পোহাতে লাগল মাঝরাত্তিরে...এখানে-ওখানে ক্যাম্পফায়ার আর ভর্তা-ভাতের পাট চুকিয়ে যেই চোখ বোজার সময় হলো, ঠিক তখনই রাতের নিস্তব্ধতাকে চিরে দিয়ে আমাদের চারপাশে ডেকে উঠল শিয়ালের দল—বুনো শিয়াল। ভয়ার্ত আমরা দিগ্বিদিকজ্ঞান হারিয়ে টর্চলাইট ধরলাম তাদের চোখ বরাবর! জ্বলজ্বলে সেই চোখের ভাষা বুঝতে বাকি নেই কারও—যেন ঠান্ডা চোখে জানিয়ে দিচ্ছে আমরাই অনাহূত এখানে, এটা তাদের এলাকা।
কে শোনে কার কথা! ভোর চারটায় ধুম করে শাহেদ চেঁচিয়ে উঠল, ‘বস্তিবাসী জাগোওওও, হুঁশিয়ার, সাবধান’—আর পায় কে! ধুমধাম করে তাঁবু ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ট্যুরিস্টের দল। সবাই ছুটে গেল আগমনরত শিয়ালের দিকে, ভয় পেয়ে ভেগে গেল শিয়ালের পাল, এরপর ঘণ্টা খানেক ধরে চলল এই পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ওরা দল বেঁধে আসে, আমরা দল বেঁধে ওদের তাড়াই। আবার আসে, আবার তাড়াই। শেষমেশ যখন ভোরের আলো ফুটল, তখন ২১ ফেব্রুয়ারি।
খালের পানিতে ভরা জোয়ারের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, কুয়াশাঢাকা ১৩টা তাঁবুর মাঝখানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পতাকাটা, ধোঁয়া ওঠা ক্যাম্পিং সাইট, আর হিমশীতল ঠান্ডা বাতাসে হেলানো-দুলানো কেওড়াবাগান। আমাদের ফেরত নেওয়ার ট্রলার যখন আবার জঙ্গলের খালে আসছে, তখন পেছনে ফেলে যাচ্ছি শান্তস্নিগ্ধ এক জল-জঙ্গলের গল্প। আর সামনে অবারিত জলরাশি হাতছানি দিয়ে ডাকছে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন একটামাত্র লঞ্চই হাতিয়ায় যায়। লঞ্চ ছাড়ে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে। সেই লঞ্চ পরদিন সকালবেলা হাতিয়া পৌঁছায়। হাতিয়া থেকে ট্রলারে করে সোজা নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। সময় লাগবে প্রায় দুই ঘণ্টা, আর ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২৫০ টাকা করে। ফেরার সময় একই পথে আসতে পারেন, অথবা হাতিয়া হয়ে চলে আসতে পারেন। ফেরার লঞ্চ কিন্তু দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে।

No comments:

Post a Comment