
হাতে সময় কম। ভারত যাবেন। অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়? একেকজন একেক পরামর্শ দিচ্ছেন। সবার পরামর্শ হলো সময় বেঁধে বেড়াতে যাওয়া ঠিক নয়! কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা সাত দিনেরই। যাত্রা কলকাতা দিয়েই শুরু। ঢাকা থেকে ১২ ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমণ শেষে পৌঁছবেন কলকাতা। হোটেল আগেই ঠিক করে রাখবেন। পরিকল্পনা ছিল পরদিন দার্জিলিং যাওয়ার। ওখানে তখন বেশ ঠান্ডা, তাই আমাদের নতুন গন্তব্য আগ্রা-জয়পুর................................................

রাত ১১টায় ছাড়বে আজমির এক্সপ্রেস। ওটাতেই সওয়ারি হব। তার আগে সময় কাটাতে গেলাম কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। কিন্তু সেদিন সোমবার জাদুঘর বন্ধ। ভবনের আশপাশেই ঘুরলাম। ভেতরে আছে বড় এক লেক আর সুবিশাল এই ঐতিহাসিক ভবন। সেগুলোই বা কম কী! বিকেল নিউমার্কেট ঘুরে রাতে ট্রেনে উঠেই দেখি আমাদের আশপাশে বাংলাদেশ থেকে আসা বেশ কিছু পর্যটক। পরের দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে আগ্রা রেলস্টেশনে নামলাম। হোটেল ঠিক করাই ছিল। হোটেলের ম্যানেজার পরদিনের পরিকল্পনা শুনে আমাদের একটা গাড়ি ঠিক করে দিলেন। সারা দিন আমাদের নিয়ে ঘুরবে। সন্ধ্যায় আমরা জয়পুরের বাস ধরব।
তাজমহল দিয়েই আমাদের আগ্রা ভ্রমণ শুরু হলো। সকালের মিষ্টি রোদ পড়েছে তাজমহলের গায়ে। পর্যটকেরা নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলছেন। তাজমহলের ভেতরে তখনো ভিড় কম। দুই ঘণ্টা ধরে শাহজাহান ও মমতাজের স্মৃতিবিজড়িত তাজমহলের আশপাশে ঘুরলাম আর ছবি তুললাম। তাজমহল থেকে বের হতে হতে দুপুর ১২টা। এবারের গন্তব্য ফতেপুর সিক্রি। তাজমহল এলাকা থেকে ৪৫ কিলোমিটারের পথ। ফতেপুর সিক্রি যাওয়ার পথে পথে অপূর্ব সরিষাখেত। কিছু দূর পরপর জমিতে দেখা যাচ্ছে ময়ূরের দল। এত দিন চিড়িয়াখানার ময়ূর দেখেছি। এবারই প্রথম দেখলাম মুক্ত পরিবেশে!
ফতেপুর সিক্রি যেন আরেক সাম্রাজ্য! নির্মাণশৈলী আর বৈচিত্র্যের কারণে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ফতেপুর সিক্রি। বিশাল সিঁড়ি মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সাদা পাথুরে দেয়ালে ঘেরা সেলিম চিস্তির সমাধিস্থল, মসজিদ। দেয়ালে দেয়ালে অপূর্ব কারুকাজ। মানুষের আশপাশেই সাহসী কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি। দেখা হলো যোধা বাঈয়ের প্রাসাদ, জাম-ই-মসজিদ, হিরন মিনার। ফতেপুর সিক্রি থেকে আগ্রার লাল কেল্লার দিকে যেতে যেতে বিকেল। শেষ সময়ে টুপ করে সূর্য ডুবে যাওয়ায় এ যাত্রা সামনে থেকেই দেখতে হলো লাল কেল্লা। তবে বাইরে থেকে দেখেই এর বিশালতা আঁচ করা গেল। সন্ধ্যার মধ্যেই আগ্রাকে বিদায় জানিয়ে বাসে জয়পুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু।
পিংক সিটি হিসেবে জয়পুরের অনেক নাম শুনেছি এর আগে। ঝকঝকে শহর। সকালে শহরে ঢুকতেই দেখা গেল মস্ত বড় গোলাপি প্রবেশদ্বার। সড়কের পাশে গাড় গোলাপি গোলাপি সব ভবন। গাড়ির চালকই আমাদের গাইড। জানালেন ১৭২৭ সালে নির্মিত এই শহর প্রাচীন শহর ভারতবর্ষের পরিকল্পিত নগরীগুলোর মধ্যে একটি। প্রথম গন্তব্যস্থল হাওয়া মহল। কারুকার্য করা অজস্র জানালাওয়ালা একটি বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এই প্রাসাদে কোনো দেয়াল বা দরজাও নেই। শুধু সারি দিয়ে সাজানো জানালা।
এরপর গেলাম জলমহলে। গ্রীষ্মকালে শীতল পরিবেশে থাকার জন্যই এই ভবনটি তৈরি হয়। তিনদিকই পাহাড়ে ঘেরা। জলমহলের উল্টোদিকেই রয়েছে রাজপরিবারের সমাধি ক্ষেত্র। ওই মহলের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দূরের রেলিংঘেরা পাড় থেকেই দেখতে হয়। হাঁটা দূরত্ব পথেই ছিল রানীমহল। ছোট ছোট স্থাপনার ওপর গম্বুজ। ভবনে কোনো দেয়াল নেই। এখানে রানীরা বিশ্রাম করতেন।
এরপর গেলাম যন্তর-মন্তর। চমৎকার একটি মানমন্দির, যা নক্ষত্র নিরীক্ষণ-নিরূপণের বিভিন্ন নিখুঁত যন্ত্রপাতি আর সূক্ষ্ম গাণিতিক হিসাবের সমীকরণে সজ্জিত। এখানকার কয়েকটি সূর্যঘড়িও দেখার মতো। এই পথেই উট বা ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো যায়।
এরপর গেলাম আমের ফোর্ট প্যালেস। দুর্গবেষ্টিত রাজপ্রাসাদটাই ছিল মূল রাজবাড়ি। মূল ভবন যেতে ওপর রাস্তা খাঁড়া মাড়াতে হয়। ওপরে উঠে পুরো এলাকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। অপূর্ব কারুকাজে নির্মিত দেয়াল আর অপূর্ব নির্মাণশৈলীর কারণে এই দুর্গও সারা ভারতবর্ষের আলাদা পরিচয় বহন করে। দুর্গের মূল ভবনের ওপর থেকে নিচের জয়পুর শহরটা দেখা যায়। শেষ বিকেলে চলে এলাম আলবার্ট হলের সামনে। প্রচুর কবুতর এখানে। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এই ভবনটি জয়পুরের কেন্দ্রীয় জাদুঘরও। ভেতরে রয়েছে পুরোনো দিনের আসবাব, অস্ত্র, দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানা উপকরণ ও প্রাচীন মূর্তি।
পরদিনও আধা বেলা জয়পুরে ঘুরলাম। স্থানীয় চিড়িয়াখানা দেখার পর খাবারের দোকান আর মার্কেটে ঘুরলাম। শুধু ঘুরে বেড়ানোর জন্য নয়, খাবারের জন্যও জয়পুরের বেশ নামডাক। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, জিলাপি বা কাবাব নান এখানে কম খরচেই পাওয়া যায়। এ ছাড়া জয়পুরের চুন্দ্রি কাপড়, কাঠের বা হাতে তৈরি শোপিসগুলোও সংগ্রহ করে রাখার মতো।
জয়পুরে দেড় দিন থেকে সেই আজমির এক্সপ্রেসেই উঠলাম ১ জানুয়ারি দুপুরে। কলকাতা এসে পৌঁছালাম ২ তারিখ রাত ১২টায়। পরদিন আবার মৈত্রী ট্রেনে দেশের পথে।
No comments:
Post a Comment