এখানে শরতের সকালে যেন অন্য রকম এক আয়োজন চলছে। নদীর বুকে ঠিকরে পড়ছে কোমল আলো। যাত্রীরা পড়িমরি করে উঠছে সমুদ্রগামী ট্রলারে। খুব ভোরে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি ঘাটে পৌঁছালাম তড়িঘড়ি। চলেছি সমুদ্রভ্রমণে। ট্রলারের লোকজনের হাঁকডাক দেখে বুঝলাম, ঘাট চিনতে ভুল হয়নি আমাদের................................
হাঁসফাঁস করে আমরাও উঠলাম সেই ট্রলারের ছাদে।
হাঁসফাঁস করে আমরাও উঠলাম সেই ট্রলারের ছাদে।
কর্ণফুলীর বুকে নোঙর করা অসংখ্য জাহাজ, ট্রলার আর কার্গো দৃষ্টি কেড়ে নিল আমাদের। বাস্তবে এত দৈত্যাকৃতির নৌযান তো দেখিনি আগে। কর্ণফুলীর মোহনায় যেতে না যেতেই কোস্টগার্ডের একটি স্পিডবোট এসে থামিয়ে দিল আমাদের ট্রলার। কোস্টগার্ডের কর্মকর্তারা ট্রলারের মাঝিমাল্লাদের শাসিয়ে দিলেন এবং চোখ রাঙিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করা অন্যায়। যা হোক, ক্রমেই বঙ্গোপসাগরের অসীম জলরাশির মধ্যে ঢুকে পড়ল আমাদের ট্রলার। আর বাতিঘরের কুতুবদিয়া আমার মধ্যে কৌতূহলও বাড়িয়ে দিল সেই সঙ্গে।
কুতুবদিয়ার বাতিঘর সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়েই আমাকে রোমাঞ্চিত করেছিল। নাবিকেরা রাতের বেলায় বাতি দেখে জাহাজের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূর থেকে নাবিকেরা কুতুবদিয়ার ঘূর্ণমান বাতি দেখতে পান। ব্যাপারটা কী দারুণ! কিন্তু পাহাড়-পর্বত ভ্রমণে ঝোঁক বেশি থাকায় কুতুবদিয়ার কথা হয়তো ভুলেই বসেছিলাম। এবার ঈদের পর বেড়াতে যাওয়ার বায়না ধরে বসলেন বন্ধু এহসান। সমুদ্রপথে কুতুবদিয়া ভ্রমণের কথা শুনে এহসান নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে ছাড়লেন না।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করে উঠল। ট্রলারে খাবারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পড়লাম বিপদে। উপকূল ধরে চলছে আমাদের নৌযান। কোথাও বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে চলে উথাল-পাতাল খেলা। একেক করে কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। এদিকে প্রচণ্ড তাপে অস্থির হয়ে উঠল যাত্রীরা। আনোয়ারা-বাঁশখালীর উপকূল ছেড়ে গভীরে চলে গেলাম ক্রমে। অপেক্ষার যেন শেষ নেই, কুতুবদিয়ারও কূলকিনারা নেই। অবশেষে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর বঙ্গোপসাগরের মাঝে যেন জেগে উঠল অচেনা এক দ্বীপ। বেলা একটার সময় নামলাম দরবার ঘাটে। তারপর জিপে চেপে বড় ঘোপ বাজার।
উত্তর-দক্ষিণে লম্বা কুতুবদিয়া দ্বীপের যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে খারাপ না। তবে নিম্নাঞ্চল ও উপকূলের অনেক জায়গায় কাঠ ও বাঁশের সেতু দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের চাঁদের গাড়ির আদলে চলাচলের জন্য এখানে আছে ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি (জিপ নামেই বেশি পরিচিত)। টেম্পো আর রিকশাও আছে পর্যাপ্ত। হাতিয়া দ্বীপেও দেখেছিলাম এ রকম যাত্রীবাহী জিপ। মহেশখালী আর সোনাদিয়ার মতো এ দ্বীপেও চলার পথে চোখে পড়ল বড় বড় লবণখেত। নাবিকদের পথ দেখানোর সুবিধার্থে ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার কুতুবদিয়ায় নির্মাণ করে বাতিঘরটি। দ্বীপটির মধ্যাঞ্চলীয় দক্ষিণ ধুরমং এলাকার পশ্চিম উপকূলে এটি অবস্থিত। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এ বাতিঘর ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে হারিয়ে যায় সমুদ্রগর্ভে। ষাটের দশকেই পুনরায় আরেকটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয় বেড়িবাঁধের ভেতরে। তবে ভাটার সময় পুরোনো বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ এখনো দেখা যায়।
No comments:
Post a Comment