Thursday, August 18, 2016

নীলকুঠিতে










এখানে প্রচুর পাখি আছে। প্রথম দিন বের হয়েই তা বোঝা গেল। দুইটা হাড়িচাঁচা একসঙ্গে বসে আছে দেখতে পেয়ে ক্যামেরা হাতে আবু জাফরের সে কী দৌড়। যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর চোখেমুখে একরাশ হতাশা। সে ক্লিক করার আগেই নাকি হাড়িচাঁচা ফুড়ুৎ। অনেক চেষ্টা করলেন একটা হলদে পাখির ছবি তুলতে, পারলেন না.................................. 

জাফরের পাখি দেখা ও পাখির ছবি তোলার নেশায় পরের দিনও সাতসকালে বের হলেন। সঙ্গে আমি, অজয় সরকার আর সংগীতশিল্পী ও উপস্থাপক শেখ শাহেদ। মেহেরপুরে বেড়াতে এসেছি আমরা।
আশ্বিন মাস চলছে তখন। কাটা হয়ে গেছে এলাকার বেশির ভাগ পাট। চারদিকে পানিতে জাগ দেওয়া পাটের গন্ধ। এলাকার একজনকে বললাম, উফ্, দারুণ গন্ধ। তিনি বললেন, দুই দিন থাকেন, এই ভালো লাগা হাওয়ায় উড়বে। সত্যি বলতে কি, তিন দিন থেকেও আমার কাছে এই গন্ধের মোহ একটুও কমেনি। বলছিলাম মুজিবনগরের কথা। এখান থেকেই বেরিয়ে এলাম মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠিতে। মুজিবনগর থেকে আমঝুপি নীলকুঠির দূরত্ব 
১৮কিলোমিটারের মতো।কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে রয়েছে বেশ কিছু নীলকুঠি। এর মধ্যে আমঝুপি নীলকুঠি অন্যতম। কুষ্টিয়া-মেহেরপুর সড়কের কাছেই আমঝুপি নীলকুঠির অবস্থান। আমঝুপি নীলকুঠির সামনে বাঁধাই করা আমঝুপি স্বর্ণালি ইতিহাস থেকে জানতে পারি, ১৯৭৮ সালের ১৩ মে খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের আমঝুপি অধিবেশনের সভায় এক সময়কার নীলকুঠিটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৯ সালে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
আমঝুপির প্রবেশমুখেই দেখা হয়ে গেল সারি সারি আমগাছের সঙ্গে। এটা হলো আম্রকানন বা আমবাগান। আমরা আম্রকানন ও কিছু প্রাচীন ভবন পেরিয়ে আমঝুপি নীলকুঠিতে পৌঁছাই। প্রবেশমুখে জটলা করে এলাকাবাসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তবে সেদিন কোনো দর্শনার্থী ছিল না। আমরা ঘুরে ঘুরে আমঝুপি নীলকুঠি দেখতে গিয়ে একটি সাইনবোর্ড ও তাতে লেখা দেখে থমকে দাঁড়াই। নীলকুঠি দর্শনের জন্য গাইড হিসেবে মালি বিল্লাল ও শফিকুলের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে। অথচ নম্বর মোতাবেক ফোন করে তাঁদের পাওয়া গেল না। ফলাফল, নিজেরাই নীলকুঠি দর্শনে নামি।
আমাদের সামনে এখন আমঝুপি নীলকুঠি লেখা যে ভবনটি দাঁড়িয়ে, সেখানে নাকি একসময় লর্ড ক্লাইভ বসবাস করতেন, মতান্তরে এটা তাঁর অফিস বা কাছারি ছিল। ভবনটির সামনেই লেখা রয়েছে, আমঝুপি নীলকুঠির ইতিহাস। নীলকুঠি থেকে হাতের বাঁ দিকে রয়েছে বিশাল মাঠ। তার পাশে বয়ে চলেছে কাজলা নদী। আমরা সেদিকটায় না গিয়ে ডানপাশের পথ দিয়ে নীলকুঠির পেছনের অংশে প্রবেশ করি। এবার চোখ চলে যায় আকাশের দিকে। স্বচ্ছ নীলাকাশ কিন্তু ওপর থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধারা নামতে দেখলাম। গুড়গুড় মেঘের ডাকও শোনা গেল। আমরা নীলকুঠির বারান্দায় আশ্রয় নিতে গিয়ে দেখি বৃষ্টি উধাও। এবার সামনে চোখ পড়তে দুচোখ ছানাবড়া। আমাদের সামনে এখন ডাক বহনকারী কবুতরের ঘর দাঁড়িয়ে। মানে হলো, সে সময় চিঠি আদান-প্রদানের জন্য যেসব কবুতর ছিল, তাদের বাসগৃহ ছিল এটি।



পাশের যে ভবনটিতে আমরা বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেটি দেখে বিস্ময় জাগল। নীলকুঠির সম্মুখভাগে দেখে এলাম এক রকম স্থাপত্য নিদর্শন, পেছনে অন্য রকম। দুই দিক থেকে দেখলে উভয়কেই মনে হবে মূল ভবনের মূল ফটক। আমাদের স্থপতি বন্ধু আসিফের কাছে জেনে নিলাম ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে আমঝুপি নীলকুঠি স্থাপিত। ভবনটির উভয় পাশে রয়েছে সারি সারি নারকেলগাছ। আর গোলাপবাগান। ঠিক তার সামনে কাজলা নদী বরাবর বিশাল শানবাঁধানো ঘাট বুঝিয়ে দেয় একসময় কতটা বিশাল আর খরস্রোতা ছিল সে নদী। বোঝা হয়ে গেল কাজলা নদীর সুসময়ে বড় বড় নৌযান চলত তার বুকের ওপর দিয়ে। ইংরেজদের নৌযান তখন এই ঘাটেই ভিড়ত। আমরা দৃষ্টিনন্দন সে ঘাটে গিয়ে দাঁড়াই। ঘাট থেকে নীলকুঠির শোভা দেখতে বেশ লাগছিল, বেশি ভালো লাগছিল নদীর বুকে সারি সারি পাটখড়ি দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য।


কীভাবে যাবেন

আমরা মুজিবনগর থেকে মেহেরপুর গিয়েছিলাম। আপনি সরাসরি মেহেরপুর চলে যেতে পারেন। মেহেরপুর সদর থেকে আমঝুপির দূরত্ব সাত কিলোমিটারের মতো। ঢাকা থেকে মেহেরপুর সরাসরি বাস চলাচল রয়েছে। মেহেরপুর থাকার জন্য মিতা, কামাল, ফিন টাওয়ারসহ ভালো কিছু আবাসিক হোটেল পাবেন। থাকার ব্যবস্থা করা যাবে জেলা সার্কিট হাউস ও পৌর হলে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা থেকেই থাকার ব্যবস্থা করে যেতে হবে। মেহেরপুর বেড়ানোর জন্য এখানকার স্থানীয়ভাবে নির্মিত যান আলম সাধু দারুণ জনপ্রিয়। ইঞ্জিনচালিত বড় ধরনের ভ্যানগাড়ি বা ভটভটিকে এখানে বলা হয় আলম সাধু। মেহেরপুরে খাবারের ভালো ব্যবস্থা পাবেন। আর এখানকার দই ও মিষ্টির স্বাদ অপূর্ব। মেহেরপুরে আমঝুপি ছাড়াও আছে ভাটপাড়া ও সাহারাবাটি নীলকুঠি। আমদহ স্থাপত্য নিদর্শন, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির ও ভবানন্দপুর মন্দির ঘুরে আসতে পারেন।





No comments:

Post a Comment