শান্তিপ্রিয় এক দেশ। অনেকে জায়গাটিকে ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন। করবেনইবা না কেন! বৈচিত্র্যপূর্ণ জলবায়ু, সবুজ উপত্যকা, হাজার হাজার ফুট উঁচুতে তৈরি পাথুরে রাস্তা, পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে নানা কসরতে লাগানো দৃষ্টিনন্দন জুমখেত, কাঠ-পাথর-টিনে তৈরি ঐতিহ্যবাহী বাড়িঘর, পাহাড়ি নদী, শীতের তুষারপাত আর মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়ানো হিমালয়—এসব কিছু নিয়েই,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
অপার মহিমায় উদ্ভাসিত ভুটান। আর এটি যে থান্ডার ড্রাগনের দেশ, তা আপনি ওখানে গেলে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন। কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট, খাবারের দোকান, কেনাকাটার জায়গা প্রায় সবখানেই এই ড্রাগনের ছবি দিয়ে সাজানো। আমাদের ভ্রমণকাহিনির শুরু ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে। থিম্পু শহরটি প্রায় ৭ হাজার ৩৭৫ ফুট থেকে ৮ হাজার ৬৮৮ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
ভোর পাঁচটা, তবে বাইরের চিত্র ভিন্ন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা ঝাঁট দিতে শুরু করেছেন। থিম্পুবাসীরাও রাস্তায় বের হতে শুরু করেছে। বেরিয়ে পড়লাম আমরাও। দুজন হেঁটে চলেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে। পরিচ্ছন্ন রাস্তা, হোটেল পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি উপত্যকার দিকে। অপরিচিত পথঘাট, জনপদ আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানছে। হঠাৎ কলকল শব্দে সেদিকে এগোলাম। কাছে গিয়ে তো চোখ ছানাবড়া! পাহাড়ি নদী মানেই সৌন্দর্যের পসরা, তা অজানা ছিল না। রাইদাক নদীর কথা বলছি, স্থানীয়রা একে ওয়াং চু বলে। ‘চু’ শব্দের অর্থ ‘জল’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ওয়াং চু হলো ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদী। নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ে গাছের সঙ্গে বাঁধা তারে ঝুলছে অসংখ্য পতাকা। আর সেই পতাকার ওপরে পালী বর্ণমালায় লেখা তিব্বতিদের বিভিন্ন ধর্মীয় বাণী। নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ছে সব পতাকা আর ছড়িয়ে দিচ্ছে অহিংসতার নীতি, আদর্শের সাতকাহন, অমোঘ ধর্মীয় বাণী, চির শান্তির বাণী। নদীর জলরাশি আর হিমালয়ের ঠান্ডা হাওয়া সেই অহিংস বাণীর ধারক ও বাহক—এই দৃঢ় বিশ্বাস গেঁথে আছে সহজ-সরল ভুটানিদের মনেপ্রাণে।
এবার গন্তব্যস্থল বুদ্ধা পয়েন্ট। থিম্পু থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরত্বে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। সর্পিলাকার খাড়া রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠছি। রাস্তার পাশে ফুটে রয়েছে অসংখ্য নাম না-জানা জংলি ফুল আর সারি সারি রডোড্রেনডনের সমারোহ। রডো মানে ‘রোজ’ আর ড্রেন্ডন মানে ‘ট্রি’। আক্ষরিক অর্থে গোলাপগাছ হলেও দেখতে মোটেও গোলাপের মতো নয়। তবে তার সৌন্দর্য গোলাপকেও ছাড়িয়ে গেছে। আশপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে কখন যে বুদ্ধা পয়েন্ট চলে এসেছি, তা বুঝতেই পারিনি। এখান থেকে পুরো থিম্পু শহরটাকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে খুব যত্ন করে বানানো অসংখ্য খেলনাবাড়ি। ১৬৯ ফুট উঁচু মূর্তিটিকে দেখতে গিয়ে তো ঘাড় ব্যথা হওয়ার উপক্রম। মূর্তিটি ব্রোঞ্জ নির্মিত হলেও এতে রয়েছে সোনার প্রলেপ আর দৃষ্টিনন্দিত কারুকার্য। বুদ্ধ মূর্তিটি বিশাল এক সিংহাসনের ওপর বসানো। আর এই সিংহাসনটি তিনতলার সমন্বয়ে গঠিত একটি মেডিটেশন হল। এর ভেতরে রয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ছোট ছোট বুদ্ধ মূর্তি, সেগুলোও ব্রোঞ্জ নির্মিত সোনার পাত দেওয়া। মেডিটেশন হলের বাইরে খোলা আকাশের নিচে বড় পরিসরে তৈরি হচ্ছে আরও অনেক সোনালি মূর্তি। মূর্তিগুলোর ওপর সূর্যের আলো পড়ছে আর দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো থেকে সোনা ঠিকরে বের হচ্ছে।
‘বুদ্ধা পয়েন্ট’ থিম্পু শহরের সব জায়গা থেকেই কমবেশি দেখা যায়। যদিও বুদ্ধা পয়েন্টে যাওয়ার আগে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি, কিন্তু ওখান থেকে ফেরার পর যেদিকেই যাই, সেদিকেই দেখি মহামান্য বুদ্ধ আমাদের ওপর কড়া নজর রাখছেন। নজর তো রাখবেনই, ১৬৯ ফুট উঁচু বিশাল এই মূর্তিটি বানানোই হয়েছে পুরো থিম্পু শহরকে দেখেশুনে রাখবেন বলে।
পুস্তকপ্রেমীদের জন্য ভুটানের জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ যেন এক স্বর্গরাজ্য। স্থাপত্যশৈলীর কথা বাদ দিলে এর অন্যতম আকর্ষণ বিশ্বের বৃহত্তম বই, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থানপ্রাপ্ত। ১১৮ পৃষ্ঠার এই বিশাল বইটির ওজন ১৩৩ পাউন্ড। এখানে যেসব বই রয়েছে, তার বেশির ভাগই হিমালয়, ভুটান, তিব্বতীয় আর সর্বোপরি বৌদ্ধধর্ম-সম্পর্কিত। এখানে রয়েছে ৬ হাজার ১০০ তিব্বতি ও ভুটানি বই, রয়েছে নয় হাজার প্রিন্টিং বোর্ড। ভুটানের জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ প্রাচীন ভুটান ও তিব্বতি সাহিত্য, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। আর এখন এটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শণীয় কেন্দ্র।
আমাদের গাড়ি এরপর ছুটে চলল আপেল-বাগানের দিকে। দূর থেকে পেয়ারা-বাগানের মতো মনে হলো। তবে আপেল ছেঁড়ার ইচ্ছা কারও থাকলে ত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ পাহারায় আছে দশাসই অনেকগুলো কুকুর।
অফিস ছুটির পর গেলাম তাশিকো জং এ। এটি ওয়াং চু নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত বৌদ্ধ মঠ ও দুর্গ। এখানে ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই এর আলিশান আকার দেখে বড়সড় ধাক্কা খেলাম। এটাকে বিশাল আকৃতির ফুটবল মাঠ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভুটানিদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এক দিন আগে গেলেই দেখতে পারতাম ওদের মুখোশ নৃত্য বা চ্যাম ড্যান্স। নানা রঙের মুখোশ আর জমকালো পোশাক পরে এই নাচে অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। এই নাচ ভুটানের সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছে।
থিম্পু জং দেশের প্রধান সরকারি ও ধর্মীয় কার্যালয়। ভুটানের রাজা ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদ এখানে বসেই রাজ্য পরিচালনা করে। পাশাপাশি এটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবেও সুপরিচিত। কোনো এক বিচিত্র কারণে ভুটানিদের সব মন্দির আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাদা রঙের প্রাধান্য চোখে পড়ার মতো। এই জংও তার ব্যতিক্রম নয়। এটিও সাদা চুনকাম করা দালান আর রয়েছে সোনার প্রলেপ দেওয়া ছাদ।
খাওয়াদাওয়া
ভুটানিদের পছন্দের খাদ্যতালিকায় রয়েছে প্রচুর মসলাযুক্ত খাবার আর সঙ্গে কাঁচা মরিচের তরকারি। থিম্পু আর পারো তে অনেক ভারতীয়, চীনা আর থাই খাবারের রেস্তোরাঁ রয়েছে।
কীভাবে যাবেন
ভুটানে চলে যেতে পারেন আকাশপথে। সময় লাগবে এক ঘণ্টা। আগে থেকে কোনো ভিসার ঝামেলা করতে হবে না। তবে হাতে সময় থাকলে সড়কপথেও যেতে পারেন ভারত হয়ে। এর জন্য আগে থেকেই ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে।
কোথায় থাকবেন
থিম্পুতে থাকার জন্য হোটেল, রিসোর্টের ছড়াছড়ি। যাঁদের বাজেট বেশি, তাঁরা উঠতে পারেন রিসোর্টে। একটু কম বাজেট হলে উঠতে পারেন হোটেল নবিউলিং, হোটেল আরিয়া, হোটেল ড্রুক, হোটেল ওজেল, হোটেল জমলহারি, নামসেলিং বুটিকে। স্পট দেখার জন্য ভাড়া করতে পারেন ট্যাক্সি বা মাহিন্দ্র ভলেরো জিপ।
No comments:
Post a Comment