মেহেরপুরের ছোট্ট শহর মুজিবনগর। ভোরবেলায় সেই শহরের সবুজ পথ ধরে হাঁটছি। সামনে দেখি উজ্জ্বল সবুজের মাঝখানে লাল রং। যেন আমাদের পতাকা। সেটিই আমাদের লঞ্চ। আমরা পাঁচজন—কণ্ঠশিল্পী শেখ শাহেদ, স্থপতি আসিফ হোসেন, আবু জাফর, অজয় রায় আর আমি। আমরা ঠিক যেন আলোর ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছি। আশপাশের সবটুকুই আমগাছে ঢাকা। সেসব গাছ ভেদ করেই পুরো....................................... এলাকা আলোর সমুদ্র হয়ে উঠেছে। আসলে রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে সূর্য টুক করে ওঠায় এমন আলোর নাচনের সৃষ্টি। রক্তিম আলো স্পর্শ করা জায়গাটি আম্রকানন। কেউবা আবার বলেন ‘আমবাগান’।
চমৎকার আমবাগানটির মালিক ছিলেন মেহেরপুরের ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারে জায়গাটির নাম হয়েছিল বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আমবাগান বা বৈদ্যনাথতলায় প্রথম অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। সেই থেকে মেহেরপুরের এই জায়গাটার নাম হয় মুজিবনগর১৯৯৬ সালে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হয়। মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স দেখতে আগের রাতে এখানে আসা আমাদের। উঠেছি পিডব্লিউডির বিশ্রামাগারে। রাতটি ছিল অমাবস্যার। আমরা আমাদের বিশ্রামাগারে ব্যাকপ্যাক রেখেই ছুটেছিলাম স্মৃতিসৌধ দেখতে। রাতের অন্ধকারে স্মৃতিসৌধ কেমন দেখায়! সে রাতে স্মৃতিসৌধের মূল বেদিতে বসে যুদ্ধের গল্প করেছি অনেকক্ষণ। শুনে শুনে মনে হয়েছে, যুদ্ধ না করতে পারাটা জীবনের বড় অপূর্ণতা। স্মৃতিসৌধে বসে সেসব ভেবে বুকের মধ্যে কী এক অস্থিরতা কাজ করেছে। বারবার মনে হয়েছে আমি কেন মুক্তিযোদ্ধা হলাম না। বিশ্রামাগারে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে ভোরে। শরতের সে ভোরে চোখ কচলে চলে আসি মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে।
স্মৃতিসৌধে এসেই দেখা হয় সুভাষ মল্লিকের সঙ্গে। সুভাষ মল্লিককে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। সংবাদপত্রের মাধ্যমে সুভাষ মল্লিকের কথা সবার জানা। সাদামনের মানুষ সুভাষ মল্লিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী নন। তবু স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর থেকেই নিয়মিত পুরো স্মৃতিসৌধ এলাকা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পুরো স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স ঘুরে দেখি। তানভীর করিমের নকশায় তৈরি মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নিয়ে অনেক তথ্য জানান সুভাষ মল্লিক। ৩০ লাখ শহীদ, উদীয়মান সূর্য, একুশে ফেব্রুয়ারি আর সে সময়ের সাড়ে সাত কোটি জনতার প্রতিচ্ছবি এই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। আমরা পুরো স্মৃতিসৌধ দেখে চলে এলাম মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে। এ নিয়ে কী বলব, আসলে চোখে দেখতে হবে। দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলবেন ‘জয় বাংলা’।
বাংলাদেশের মানচিত্র নয়, এ যেন যুদ্ধদিনের বাংলাদেশ শুয়ে আছে। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, পলক পড়তে চায় না। এর মধ্যে আবু জাফরের ধাক্কা আগে চল। আমরা এগিয়ে চলি। মানচিত্রকে ঘিরে অনেক ডায়ওরামা (মডেল)। এমন একটি ডায়ওরামায় দেখা যায় পাকিস্তানি হানাদারেরা আক্রমণ করে ধ্বংস করেছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনার। বিধ্বস্ত শহীদ মিনার দেখে পাশেই দেখতে পাই একই অবস্থায় আমাদের জাতীয় প্রেসক্লাব, সচিবালয়সহ পুলিশ লাইন, পিলখানা, বধ্যভূমি তুলে ধরা হয়েছে এসব ডায়ওরামার মাধ্যমে। আমরা এসব দেখে দেখে সদলবলে চলে আসি ওয়াচ টাওয়ারের ওপর। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখি স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ বাংলাদেশের মানচিত্র। আমাদের যুদ্ধকালীন অবস্থার রূপক। কোথায়, কোন এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে, শরণার্থীরা কীভাবে সে সময় ভারত যান বা দেশ ছাড়েন সবই বোঝা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রে। মানচিত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এবার আমরা চলে এলাম মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের সামনের অংশে। এখানে বঙ্গবন্ধু হাত উঁচিয়ে বক্তৃতা করছেন। তখনই যেন তাঁর ভরাট কণ্ঠে ভেসে এল, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম...। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলন, মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সহযোগিতায় বাঙালি নারী-পুরুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন বিভিন্ন ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা দেখে যেমন রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলাম, তেমনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য দেখে উচ্ছ্বসিত হলাম। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলাম—জয় বাংলা।
যেভাবে যাবেন
আপনিও মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স ঘুরে আসতে পারেন। মেহেরপুর জেলা সদর থেকে মুজিবনগর আধঘণ্টার পথ। ঢাকা থেকে মেহেরপুর সরাসরি বাস চলাচল রয়েছে। ঢাকার গাবতলী থেকে মেহেরপুরের বাস ছাড়ে। মেহেরপুর থাকার জন্য মিতা, কামাল ও ফিন টাওয়ারসহ ভালো কিছু আবাসিক হোটেল পাবেন।
No comments:
Post a Comment