আমরা বগা লেকের ধার ধারলাম না, এক টানে চলে গেলাম কেওক্রাডাং পেরিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম, পাসিংপাড়ায়। বাতাসে মেঘের গন্ধ, সন্ধ্যার অন্ধকারকে মেঘের অন্ধকার এসে টুপ করে গিলে ফেলেছে, ঠান্ডা মেঘের ভেতর দিয়ে আমরা যখন কেওক্রাডাং পার হই, তখন আশপাশে কোথাও মণ্ডলকে খুঁজে পেলাম না! একটু পরেই মেঘ হালকা হয়ে গেলে দেখা গেল মণ্ডলকে, কেওক্রাডাংয়ের হেলিপ্যাডে উঠে হাঁ করে লাফিয়ে লাফিয়ে যেন মেঘ খাচ্ছে লালমনিরহাটের শান্ত-সরল ছেলেটা। জীবনে যে কখনো মেঘের সাগরে ভেজেনি, তার জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। তাকে পাগলামি করতে দিয়ে আমরা রাতের রান্নার আয়োজনে বসে গেলাম।
চারপাশের মেঘের কম্বলের মাঝে একটুখানি আগুনের উষ্ণতা, আসলেই স্বর্গীয় অনুভূতি। এই পাসিংপাড়া আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গাগুলোর একটা। এখানে পায়ের পাতা ছোঁয়া মেঘেদের এলোমেলো ভিড়ে ঝিলিক দেয় বজ্রপাতের আলো, মাঝরাতে দমকা বাতাসে উড়ে যেতে চায় মাথার চুলগুলো। আর সকাল? সে যেন এক পরির নগরী, যেখানে সাদা মেঘগুলো ছুঁয়ে দেয় খোঁচা খোঁচা দাড়িভরা এই অমসৃণ মুখটা। যেখানে মেঘের সাগরে ডুবে থাকে আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলো।
আরামের ঘুমে পানি ঢেলে দিলেন গাইড আলমগীর ভাই। সাতসকালে উঠে সে কী নাচানাচি, ‘আপনেরা ঘুমাইতে আসছেন নাকি, পাহাড়ে কেউ নাক ডাইকা ঘুমায়! পাহাড়ে মানুষ আসে ঝরনা দেখার জন্য, পাত্থর দেখার জন্য, পাহাড় দেখার জন্য!’ আমরা তাঁকে শান্ত করার জন্য এক চোখ খুলে জানালা দিয়ে পাহাড় দেখে ইশারায় তাঁকে জানিয়ে দিলাম, আমাদের পাহাড় দেখা শেষ, সোনার বাংলাদেশ। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা—কাছেই নাকি একটা ঝরনা আছে, নাম ডাবল ফলস। এই ঝরনাতে নাকি দুই দিক দিয়ে পানি পড়ে, এই ঝরনা না দেখলে বেঁচে থাকার কোনো মানে নাই! মণ্ডল খুব একটা গা করল না, তার বাসায় বাথরুমের দুইটা কলেও নাকি একসঙ্গে পানি পড়ে, কাজেই এটা তার জন্য রোমাঞ্চকর কিছু না। কিন্তু আমরা আরামের ঘুম ফেলে ঝরনা দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং সত্যি বলতে কি জীবনে যে কয়টা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেগুলোর মধ্যে এটা ছিল একটা।
এরপরের গল্পটুকু রোমাঞ্চের। পাসিংপাড়ার আদাখেত ছাড়িয়ে, হাজার ফুটের পাথুরে সিঁড়ি মাড়িয়ে, নাম না-জানা ঘাসফুলের জংলি বাগান নাড়িয়ে, অচেনা ঝিরিপথের ঠান্ডা পানিতে দাঁড়িয়ে যখন সুংসানপাড়ার মাঝখান দিয়ে হেলেদুলে যাচ্ছি, তখনই মনে হচ্ছিল আরও একটা অসাধারণ জিনিস দেখতেই বুঝি রওনা দিলাম। বরাবরের মতো এবারও মায়াবী পাহাড় আমাদের নিরাশ করেনি। সুংসানপাড়া থেকে নামতে নামতে মাথাসমান উঁচু ঘাস আর জংলি গাছ ঠেলে যখন ঝরনায় যাওয়ার পথে এসে দাঁড়ালাম, ততক্ষণে প্রচণ্ড পরিশ্রমে আমাদের সবার গা বেয়ে ঘামের ঝরনা ছুটে চলেছে। এরপর নতুন রোমাঞ্চের শুরু, কাশফুলের মতো একধরনের গাছের জঙ্গলে এসে দম আটকে আসার জোগাড় আমাদের। বাতাসে ফুলের রেণু উড়ছে, দম নেওয়ার সুযোগ নেই। নাকে গামছা বেঁধে চলা শুরু করতেই নাহিদ ভাই আছড়ে পড়ল কয়েক ফুট নিচের এক মরা গাছের ওপর। পাহাড় কাঁপিয়ে আমরা
হেঁসে উঠলাম। পাশ থেকে একদল বানর আমাদের দিকে লাল চোখ করে তাকিয়ে দূরে চলে গেল।
খাড়া পাহাড়ের দেয়াল টপকে আমরা অবশেষে নেমে গেলাম ডাবল ফলসের গোড়ায়। বিশাল এই পাহাড়ি ঝরনায় দুই পাশ থেকে সমানতালে পানি পড়ে। মজার ব্যাপার হলো, এই ঝরনাটার এক পাশের পানি বরফের মতো প্রচণ্ড ঠান্ডা, আর অন্য পাশের ঝরনাটার পানি তুলনামূলকভাবে কম ঠান্ডা। একেবারে ঠান্ডা পানিটা আসছে অনেক দূরের বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম জারুছড়িপাড়া থেকে, আর অন্যটা সুংসানপাড়ার নিচের কোনো এক জায়গা থেকে। এই দুই ঝরনার পানি এক হয়ে জমা হচ্ছে ঝরনার নিচের মাথাসমান উঁচু স্বচ্ছ এক
পুকুরে, সেখান থেকে পানিটুকু অমিয়াখুম, নাফাখুম হয়ে সাঙ্গু নদে গিয়ে মিশেছে।
কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়, এই প্রবাদটা মনে হয় এ রকম কোনো ঝরনা দেখেই বলা হয়েছে। প্রায় ঘণ্টা দু-এক পাহাড়ি পানির শাসন দেখে আমরা যখন ফিরছি, তখন শেষ বিকেলের মরা আলো আমাদের পথ দেখিয়ে লোকালয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর আকাশের গায়ে ফুটে উঠছে একটা-দুইটা-দশটা-পঞ্চাশটা তারা।
No comments:
Post a Comment