Tuesday, August 16, 2016

হেঁটে হেঁটে ঝিরিপথে







বিকেল চারটা। ট্র্যাকে হাঁটা শুরু হয়েছিল ভোর পাঁচটায়। শেষের দিকে দড়ি বেয়ে বেয়ে (রোপ ক্লাইম্বিং) পাহাড়ের যেখানে উঠে এসেছি, তার সামনে তাকাতেই দৃষ্টি আর সরে না। আমরা যেন পাহাড়ের ওপর নয়, পৃথিবীর মাথায় দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছি। আকাশ থেকে জলাধার এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পানির ঝাপটায়। বিভোর আমরা। অন্য কিছুতেই খেয়াল নেই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে........................................

 থাকলাম অনাবিল মুগ্ধতায় ভরা সেই অপরূপ নির্জন দুনিয়ায়!

শেষ বর্ষার একদিন ঝরনার কুলকুল ধ্বনি শুনতে আর ঝরনার জলের ঝাপটা খেতে ইউনিক পরিবহনের বাসে চেপে রাত চারটায় সীতাকুণ্ড পৌঁছায়। বাস থেকে নেমে যাত্রীছাউনিতে সবাই বসলাম ব্যাকপ্যাক নিয়েই। চট্টগ্রাম থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও তিনজন। আমরা মোট ১৭ জন। ইতিমধ্যে যে যার মতো পোশাক পাল্টে নিতে শুরু করেছি। ভোর পাঁচটা বাজতেই একটা লেগুনা থামিয়ে সবাই মিরসরাইয়ের দিকে রওনা হই, নামি ছোট দারোগার হাট।দারোগার হাট থেকে শুরু হবে আমাদের হন্টন, মানে ট্র্যাকিং। এক ঘণ্টা হাঁটার পর চলে আসি লবনাকুণ্ড হয়ে সূর্যকুণ্ড ও সহস্রধারা জলপ্রপাত। ঘণ্টা খানেক আমরা সহস্রধারা জলপ্রপাতে কাটিয়ে রওনা হই বড় দারোগার হাটে। এখানে এসে এক ফাঁকে সকালের খাবারটা খেয়ে নিই। এরপরই শুরু আমাদের মূল অভিযান পর্ব।


বড় দারোগার হাট থেকে মহাসড়কের অনেকখানি হেঁটে কমলদহের পথ ধরি। তারপর তো সারা দিন চষে ফিরি কমলদহ আপারস্ট্রিম ট্রেইল। মোটামুটি অপরিচিত ট্রেইল, বড় কমলদহ থেকেই ছড়ার শুরু। অসাধারণ এই ট্রেইলের ওপরের অংশে আছে চার-পাঁচটি বড় ও মাঝারি আকারের ঝরনা এবং অসংখ্য ছোট-বড় ক্যাসকেড (জলপ্রপাতের একাংশ)। কমলদহ ঝরনাটি তিন ধাপের। বিশাল এই ঝরনাটি দেখতে যেমন অসাধারণ, তেমনি বিপজ্জনক। আমরা আসলে দেখতে গিয়েছিলাম ছাগলকান্ধা ঝরনা। শুরুতেই কমলদহ ঝরনা দেখার পর ছাগলকান্ধা দেখে ফেরার পথে বোনাস হিসেবে পেয়ে যাই পাত্থরভাঙ্গা ঝরনা।
আমরা যখন কমলদহের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি, আকাশ তখনো ঘন মেঘে ঢাকা। সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাট পেছনে ফেলতেই শুরু হয় অঝোর বৃষ্টি, ঝুম বৃষ্টিতেই আমরা এগিয়ে চলি। কমলদহ চলে আসতেই চারদিকে সবুজ দেখে মন ভালো হয়ে যায়। যে ভালো লাগা সেদিন একটিবারের জন্যও কমেনি। আমরা এই পথে ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে পেয়ে যাই ঝিরিপথ।
ঝিরিপথের দুপাশে কখনো ঘন জঙ্গল আবার কখনো ঘাসের ঢাল বেয়ে চলতে হচ্ছিল। কত নাম না-জানা বুনোফুল ও ফল, ফার্ন ছিল অজস্র, হাতের তালুর মতো পাতার বিষকচু, অর্কিডও চোখে পড়েছে মাঝেমধ্যে। অনেক পরিচিত দাঁতরাঙা বা প্রচুর ল্যান্টানা দেখে নাম জানার আনন্দে অনেকেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে। বনকলা থেকে শুরু করে বনআদা সবই ছিল এই পথে। ডুমুর ও কেওড়া ফলের স্বাদ নিয়েছি, সঙ্গে নিজেদের শুকনো খাবার।
অসাধারণ ঝিরিপথ, এত এত গাছ ও ফুল দেখে বারবার ক্যামেরা তাক করতে হচ্ছিল। এভাবেই একসময় চলে আসি ছাগলকান্ধা। আমাদের শেষ গন্তব্য পাত্থরভাঙ্গা ঝরনা। ছাগলকান্ধা ও পাত্থরভাঙ্গা যাওয়ার আগের জায়গাটুকুতে ঝিরিপথ ইংরেজি ওয়াই আকার ধারণ করেছে, বিস্ময়করও বটে। আরও অপার বিস্ময় আর সৌন্দর্য নিয়ে বসে ছিল দুই পাশের দুটি ঝরনা। প্রকৃতির কোলে ঝরনাধারা দুটি সুন্দর সাজে বসে যেন আমাদের অপেক্ষায় ছিল।
ছাগলকান্ধা সহজ হলেও পাত্থরভাঙ্গার পথ খুব কঠিন। সেই কঠিনেরে জয় করার পর দারুণ এক ভালো লাগায় মন ভরে উঠেছিল। ঝাড়া দুই ঘণ্টা আমরা ঝরনাতে কাটাই। ঝরনার জলে স্নান করি, ছবি তুলি ফটাফট। কারও কোনো আক্ষেপ ছিল না, ছিল না ক্লান্তি। ঝরনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শেষবেলায় যখন পাহাড়ের ওপর উঠে পথ হারিয়ে ফেলি, তখনো সবাই দূর থেকে সমুদ্র ঊর্মিমালার এক ঝলক দেখে আনন্দে চিৎকার করে বলেছে, এ হলো শেষবেলার সুখ!

দরকারি তথ্য

চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে চড়ে বসলেই হবে, নামবেন সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাট। পরিচিত পথনির্দেশক থাকলে তো কথাই নেই। তা না হলে সঙ্গে স্থানীয় গাইড নিয়ে নেবেন। এবার আপনাকে মহাসড়ক ধরে ঢাকার দিকে ২০ মিনিটের মতো হাঁটতে হবে। তারপর কমলদহ গ্রামের ভেতর আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটলে পেয়ে যাবেন ঝিরিপথ। অসাধারণ সে ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা হবে কমলদহসহ পাত্থরভাঙ্গা ও ছাগলকান্ধা ঝরনা বা জলপ্রপাত। এর বাইরে আপনার সঙ্গে আরও কিছু ঝরনা ও ক্যাসকেডের দেখা মিলবে। এর বাইরে অন্য সব ঝরনাকে স্থানীয় লোকজন ঠিক ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। আরেকটা কথা, আপারস্ট্রিমের সব ঝরনা দেখতে হলে এক দিন তো লাগবেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেড় দিনও লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে সীতাকুণ্ড ফিরে রাত যাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে চেষ্টা করবেন এক দিনেই পুরো ট্রেইল শেষ করতে। গাইড প্রতিদিনের জন্য ৬০০ টাকা নেবেন।
সচেতনতা
ঝিরিপথ ও জলপ্রপাতে একটু সাবধান ও সর্তকতার সঙ্গে চলাচল করবেন। খাবার স্যালাইন, পানি, শুকনো খাবার এবং প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। পরিবেশ হুমকিতে পড়ে এমন কিছু অবশ্যই করা চলবে না। পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপন্ন হয় এমন কিছু ফেলে আসবেন না।

1 comment: